সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
আলী আমিন, যুক্তরাজ্য
একটি দেশের সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা আছে এমন অনেকেই যোগদান করতে পারেন, এতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগদান করেও যদি আপনি ওই রাজনৈতিক দলের জন্যে গোপনে কাজ করতে থাকেন ও আপনার সমর্থিত রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় আসলে সেই দলের স্বার্থকে দেশ ও জনগনের উপরে স্থান দেন তাহলে অবশ্যই আপনি অন্যায় করছেন এবং সামরিক আইনও ভঙ্গ করছেন।
আজকে আমি আপনাদের সামনে এমন দু’জন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরবো যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হওয়া সত্বেও দলীয় নেতার মত আওয়ামী লীগের দলীয় স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছেন।
গতকাল শেখ হাসিনার পেছনে সদ্য কমিশন প্রাপ্ত একজন ২লেঃ এর ছবি আমি পোস্ট করেছিলাম, তিনি হলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা একেএম এনামুল হক শামীমের ভাই একেএম আমিনুল হক, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল।
এই আমিনুল হক ২০১৬ হতে ২০২০ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা এডভাইজর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
প্রতিরক্ষা এডভাইজর হিসেবে নিয়োগ পেলেও আমিনুলের মূল কাজ ছিলো যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সরকারের সমালোচক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রবাসী বাংলাদেশীদের উপর নজরদারী করা এবং বেশ সফলতার সাথেই তিনি এই কাজগুলো পরিচালনা করেছেন।
সেদেশের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করে তিনি তৈরী করেছিলেন একটি বিশেষ সোর্স নেটওয়ার্ক এবং এই কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করতে বাংলাদেশের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন পদবীর কর্মকর্তাদের পরিচয় গোপন করে তাদের স্টুডেনট ও ভ্রমন ভিসায় যুক্তরাজ্যে যাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি।
ছাত্র, ব্যবসায়ী ও পর্যটকের কভারে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের পর এদের মূল কাজ হতো বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নির্ধারিত টার্গেটের উপর (রাজনৈতিক নেতা, সমালোচক, সাংবাদিক) এদের বাসস্থান, কর্মস্থল, ব্যক্তিগত মুভমেন্ট এসব নজরে রাখা ও টার্গেটের প্রোফাইল তৈরী করা।
যুক্তরাজ্যের মত একটি দেশে এ ধরনের গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা কেবল অন্যায়ই নয় এটি বেশ গুরুতর একটি অপরাধ, আর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা এডভাইজর হয়ে সে অপরাধ সংঘটিত করেছেন একেএম আমিনুল হক।
গোয়েন্দাদের এই সার্ভেলেন্স রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে হয়রানী করা হতো যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ভিন্নমতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আওয়ামী সরকারের সমালোচকদের, যা এখনো চলমান।
হয়রানীর প্রকারভেদও বেশ চমকপ্রদ, যেমন ধরুন আপনি পাসপোর্ট নবায়ন করতে বা No visa required স্টিকার পাসপোর্টে সংযুক্ত করার জন্যে হাইকমিশনে গেলে আপনাকে প্রতিবারই ভিন্ন তারিখ দেয়া হবে বা অনেক রকম টাল-বাহানা করে সাধারন কনস্যুলার সার্ভিস থেকেও বঞ্চিত করা হবে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভ্রমন করলে সেখানে মামলা-মোকদ্দমা করে বাজে রকমের হয়রানী করার নজিরও রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত প্রতিরক্ষা এডভাইজরের কার্যালয় যেন একটা কর্তৃত্ববাদী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এক্সটেনডেড উইং এ পরিনত হয়েছে!
আর কেনই বা হবেনা, এই আমিনুল হক যুক্তরাজ্যে যাবার আগে ডিজিএফআই’র খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ; পরিচালক এসআইবি (Signal Intelligence Bureau) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
চাকুরী শেষে দেশে ফেরার পর আওয়ামী লীগের প্রতি তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতীও দেয়া হয়, তার ভাই মন্ত্রী শামীম সাহেব এই পদোন্নতীর জন্যে শেখ হাসিনার প্রতি একটি পোস্টে কৃতজ্ঞতাও জ্ঞাপন করেন।
পরবর্তীতে প্রতিরক্ষা এডভাইজর হিসেবে আমিনের স্থলাভিষিক্ত করা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য জনাব মামুনুর রশীদের ছোটভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রশীদ, যিনি দেশে থাকা অবস্থায় পিজিআরে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।
তিনি গোয়েন্দাবৃত্তিতে আমিনুলের মতই শার্প, কিন্তু ভদ্রলোক আমার ও তাসনীম খলিলের উপর নজরদারী করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান। ঘটনাটি বেশ মজার, এ বছরের ২৮শে জানুয়ারী আমি ও তাসনীম ভাই বাংলাদেশ দূতাবাস লন্ডনে যাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী বংশোদভূত সাংবাদিক কনক সারোয়ারের বোন রাকা’র মুক্তির বিষয়ে একটি স্মারকলিপি প্রদান করতে, যাবার পথে আমরা ভাবছিলাম যেহেতু হাইকমিশন কর্তৃপক্ষ আমাদের কর্মসূচীর ব্যাপারে অবগত, না জানি কোন ধরনের কান্ড তারা ঘটাবে!
সেখানে পৌঁছে হাইকমিশনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি পুরো ভবনের ভেতর থেকে বিভিন্ন এংগেলে দাঁড়িয়ে তারা আমাকে ও তাসনীম’কে মোবাইলে ভিডিও করছেন! আর আতংকে তারা হাইকমিশনের দরজাও খুলছেন না!
এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি এক কোনায় দাঁড়ানো দুইজন লোক, বেশভূষায় সরকারী ছাপ বেশ স্পষ্ট , কাছে গিয়ে কথা বলতেই বুঝলাম আমাদের স্পট করার জন্যেই তারা অপেক্ষা করছিলেন। তারা বেশ সন্মানের সাথেই আমাদের সাথে ব্যবহার করলেন ও ফোনে ভেতরে জানালেন আমরা কেন এসেছি।
হঠাৎ দেখতে পেলাম আমার ও তাসনীম’ভাইর পেছনে ক্যাপ পরিহিত এক ব্যক্তি আমাদের কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে, আমি ঘুরে তাকে প্রশ্ন করলাম “এই আপনাকে তো আমি চিনি, আপনি ব্রিগেডিয়ার মাহবুব স্যার, কেমন আছেন?”
আমি যে এভাবে তাকে হাতেনাতে ধরবো এটা তিনি মোটেও আশা করেননি! হতভম্ব হয়ে একটু ক্যা, ক্যো করে ভ্যানিশ হয়ে গেলেন, পরে দেখলাম তার একজন স্টাফকে দিয়ে আমার গাড়ীর ছবি তোলার চেষ্টা করছেন, আর যখন ওই স্টাফ কে ডাক দিলাম, সে জান-প্রান নিয়ে দৌড়ে হাই কমিশনের মধ্যে ঢুকে গেলো। আমি যখন জিজ্ঞাস করলাম ছবি কেন তুলেছেন? তিনি শুধু বললেন “আমি কিছু জানিনা, আমি কিছু জানিনা”
মেজর জেনারেল আমিনুল ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রশিদে’র মত সেনা কর্মকর্তার সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়, আওয়ামী সরকার সব সময়ই বলে এসেছে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন হবে তাদের অধীনে, যে নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
যেখানে সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ প্রায় সকল কর্মকর্তাই আওয়ামী ঘরানার, সেখানে তারা কিভাবে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করবে?
প্রকাশক, দৈনিক নবযুগ