আমাদের আমলা-মন্ত্রী ও শিক্ষা ব্যবস্থা
আলী আমিন, যুক্তরাজ্য
জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জনকদের অন্যতম একজন হলেন ম্যাক্স প্ল্যাংক। তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী, বুদ্ধিজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্ল্যাঙ্ক পরিবারে ধর্ম একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল কারণ তার পিতামহ এবং প্রপিতামহ উভয়েই ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন। প্ল্যাংক ছিলেন জন্মগতভাবেই সংগীতে বিশেষ প্রতিভাধর শিশু। তার পরিবার যখন তার এই প্রতিভা টের পায় তারা তাকে গানের স্কুলে ভর্তি করায় এবং সেখানে তিনি পিয়ানো, অর্গান এবং সেলো বাজানো শিখেছিলেন। তিনি গান এবং অপেরাও রচনা করেছিলেন।
১৮৬৭ সালে, প্ল্যাংক ম্যাক্সিমিলিয়ান জিমনেসিয়াম স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে তিনি হারমান মুলার নামের একজন বিশেষ প্রতিভাবান শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসেন। হারমান মুলার একজন গণিতবিদ যিনি প্ল্যাঙ্কের বিশেষ প্রতিভা টের পেয়েছিলেন। কে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এই শিক্ষক মুলারের কাছ থেকে মাত্র ১০ বছর বয়সে শক্তি সংরক্ষণের নীতি (conservation of energy), যে শক্তি তৈরি বা ধ্বংস করা যায় না, সম্মন্ধে শিখেছিলেন। এভাবেই প্ল্যাঙ্ক প্রথম পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রের সংস্পর্শে আসেন।
উপরের দুটো প্যারাগ্রাফ থেকে আমরা কি শিখতে পারি? ১। পরিবার একটি স্কুল যেই স্কুলের সকল বড় সদস্যই ছোট সন্তানদের একেকজন শিক্ষক। ২। তার পরিবার তার সংগীতের প্রতি জন্মগত প্রতিভার সীকৃতি দিয়েছিল। ৩। স্কুলে একদম প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে মান সম্মত শিক্ষকের গুরুত্ব।
বুঝতে চেষ্টা করুন একটা ১০ বছরের বাচ্চার পদার্থবিজ্ঞানের তৎকালীন ফ্রন্টিয়ারের বিষয় সম্মন্ধে জেনেছিল। সেই স্কুলটা কেমন স্কুল? স্কুলের নামের মধ্যেই আছে। জার্মানিতে শিক্ষার মূল ধারাকে বলে জিমনাসিয়াম। প্ল্যাংক পড়েছিলেন ম্যাক্সিমিলিয়ান জিমনেসিয়াম স্কুলে। জার্মানির অন্যান্য ধারাগুলো হলো কারিগরি ও ভোকেশনাল। যারা ঐসব ধারায় পড়বে সেখানে পড়েও কেউ যদি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে সেখান থেকেও পরবর্তীতে মূল ধারা জিমনাসিয়ামে আসতে পারে। অর্থাৎ ধারাই dead end রাস্তার মত না।
এইবার আসুন আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা করি। এতক্ষনতো আমরা ১৮৬০-৭০ সাল নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু আমরাতো বাস করছি ২০২০-৩০ সালের সময়ে। এই ১৫০ বছরে পৃথিবী জ্ঞান সৃষ্টির বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেই সময় থেকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। এখন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে হলে ইতিমধ্যে সৃষ্ট জ্ঞান সম্মন্ধে জানতে হবে। সুতরাং জানার ভলিউম এখন অনেক। এই সময়ে এসে আমরা কি করলাম? আমরা স্কুলের কারিকুলামে বিজ্ঞান সুচিকে মারাত্মকভাবে সংকোচিত করলাম।
আগে মানে বিদ্যমান নিয়মে ১৩-১৪ বছরের শিক্ষার্থীরা নবম শ্রেণীতে এসে যে যার পছন্দমত বিভাগে বিভক্ত হতো। সাধারণত যারা বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ইত্যাদি হতে চাইত তারা বিজ্ঞান বিভাগ নিত। বিজ্ঞান বিভাগকে অনেকেই কঠিন ভাবতো কারণ এখানে পদার্থবিজ্ঞান রসায়ন ও উচ্চতর গণিতের মত বিষয় ছিল। অনেক শিক্ষার্থীর এইসব বিষয়ে ভীতি থাকে। বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়লে সুবিধা হলো ইচ্ছে করলে পরবর্তীতে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করা যায়। আমাদের বাংলা বিভাগ, অর্থনীতি বিভাগ, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগসহ মানবিক ও ব্যবসার অনেক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আছেন যাদের এসএসসি ও এইচএসসিতে বিজ্ঞান ছিল। উল্টোটার উদাহরণ নাই। অর্থাৎ মানবীকে পড়ে পরবর্তীতে বিজ্ঞান পড়া যায় না।
তাহলে নতুন শিক্ষাক্রমে আমরা বিজ্ঞানকে অবনমিত করে মানবিক এবং এর চেয়েও আরো খারাপ দিক হলো কিছুটা কারিগরি শিক্ষার দিকেও নামালাম। আগে যদি এসএসসি এইচএসসিতে মানবিকে পড়ে বিজ্ঞানে না আসতে পারতো এখন নতুন শিক্ষাক্রম পড়ে বিজ্ঞানে পড়ার সক্ষমতা কমলো। এই সহজ কথাটি বুঝতে এত কঠিন লাগে কাদের? তাদের লেখাপড়ার মান নিয়ে তখন আমার প্রশ্ন জাগে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে এসে যেখানে আমাদের উচিত আরো বেশি করে বিজ্ঞান পড়ার সুজাত সৃষ্টি করা সেখানে আমরা সংকুচিত করছি। আমার ধারণা এইটা করা হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ এবং আমাদের কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে তাদের সৃষ্ট জ্ঞান ও প্রযুক্তির ভোক্তা বানানোর জন্য সুপরামর্শের আবরণে এইসব কু পরামর্শ দিচ্ছে। আর ক্ষমতালোভীরা তাই খাচ্ছে আর আমাদেরকে সবক দিচ্ছে।
হেসে খেলে লেখাপড়া হয় না। কারিকুলাম থেকে বিজ্ঞান কমিয়ে ভবিষ্যতে বড় বিজ্ঞানী পাওয়ার আশা করা যায় না। তাই হেসে খেলে শেখানোর নতুন যেই তরিকা আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর শিক্ষা মন্ত্রী দিচ্ছে তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা উচিত। মনে রাখতে হবে এরা এইটা করছে কেবল বাংলা মাধ্যমের ক্ষেত্রে। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা কি আমাদের দেশের ছেলেমেয়ে না? তাদের কি তথ্য প্রযুক্তি বিষয় শেখার দরকার নাই? তাদের কি “জীবন ও জীবিকা” বিষয় পড়ার দরকার নাই? তাদের কি শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয় শেখার দরকার নাই? তারা কেন পূর্ণ মানের পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গণিত পড়বে? আর এই দুই মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীরা যখন এক সাথে হবে তারাতো মিশতে পারবে না। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা হীনমন্যতায় ভুগবে। অথচ বর্তমান কারিকুলামে পড়ে আসারা কিন্তু হীনমন্যতায় ভুগতো না। আমার বড় কন্যা বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য যখন SAT পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন দেশের কিছু সেরা বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীর সান্নিধ্যে এসেছিল। এই সুবাদে আমি ও আমার স্ত্রীও। আমার স্ত্রী কন্যারা তাদের মান দেখে মুগ্ধ। এদের অনেকেই এখন বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল ফাউন্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা ও কানাডায় পড়ছে।
আমাদের কারিকুলামতো খারাপ না। খারাপ হলো আমাদের আমলা মন্ত্রী।আমাদের যেটা দরকার ছিল সেটা হলো বাংলাদেশের সকল স্কুল কলেজকে নটরডেম, হলিক্রস ও সেইন্ট জোসেফের মানে উন্নীত করা। অর্থাৎ শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করা যেন ম্যাক্স প্ল্যাংক ১০ বছর বয়সে যেই মানের শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন সেই মানের শিক্ষকদের সান্নিধ্যে যেন আমাদের ছেলেমেয়েরা আসতে পারে সেটার পরিবেশ তৈরী করা। লেখাপড়ার পরিবেশ’তৈরী না করে কারিকুলাম যেটাই করি না কেন কোন লাভ হবে না। বিশ্ব মানের শিক্ষক নিয়োগ দিলে কারিকুলাম না থাকলেও তারা যা পড়াবে সেটাই হয়ে যাবে কারিকুলাম এবং সেটাই হবে যোগোপযোগী ভালো মানের। সক্রেটিস, প্লেটো এরিস্টটল কি কারিকুলাম ফলো করতেন? অথচ তারাতো একটা সভ্যতা বিনির্মাণ করে ফেলেছিলেন।
প্রকাশক, দৈনিক নবযুগ