১২ জনের অবৈধ সম্পদের খোঁজে সিআইডি

ক্যাসিনোকাণ্ডের পর এখন পর্যন্ত ১২ জনের অবৈধ সম্পদের হিসাব খুঁজছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এর মধ্যে আটজনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। বাকি চারজনের ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। ওই চারজনের অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিললে তাদের বিরুদ্ধেও মামলা হবে।

সিআইডির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ১১ জনের অবৈধ সম্পদের হিসাব জানতে দেশি-বিদেশি ২৪টি সংস্থার কাছে দেওয়া চিঠির জবাবের অপেক্ষায় আছেন তারা। এখন পর্যন্ত কেবল ঠিকাদার জি কে শামীমের সম্পদের হিসাব বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পেয়েছে সিআইডি। তার সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখার পর পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিআইডির পাশাপাশি ১০০ জনের সম্পদের তথ্য চেয়েছে দুদক। কয়েকজনের অর্থ পাচারের তথ্য জানতে শিগগিরই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম দেশের বাইরে যাচ্ছে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিআইডির ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ সমকালকে বলেন, যাদের সম্পদের খোঁজ নিতে বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেই জবাব পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। এখন পর্যন্ত একজনের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে। আরও ১১ জনের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তার মধ্যে আটটি মামলা রয়েছে।

এখন পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে তারা হলেন, জি কে বিল্ডার্সের কর্ণধার জি কে শামীম, যুবলীগ দক্ষিণের বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কাউন্সিলর মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান, অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান, ক্যাসিনো হোতা দুই ভাই এনামুল হক ওরফে এনু ভূঁইয়া ও রূপন ভূইয়া। এর বাইরে আরও চারজনের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। তবে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি নন সংশ্নিষ্টরা।

একাধিক সূত্র জানায়, ক্যাসিনোকাণ্ডের পর যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদের বাইরেও অনেকের অবৈধ সম্পদের খোঁজ নিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধির ব্যাপারেও তথ্য নেওয়া হচ্ছে।

তদন্ত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ক্যাসিনোকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে যারা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে। অন্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা হয়েছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে তা প্রমাণিত হলে সবার অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে। এ ছাড়া গ্রেফতাকৃতরা তাদের সম্পদ বেনামে অন্য যাদের কাছে রেখেছেন, তাদের ব্যাপারেও তদন্ত শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে জি কে শামীম ও খালিদের সম্পদ বেনামে অন্যত্র রাখার তথ্য মিলেছে। বিদেশে কেউ সম্পদ পাচার করেছেন কি-না সেই তথ্য নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

পুলিশের অভিযোগ, জি কে শামীম ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত। তিনি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতেন। দেহরক্ষীর বিশাল বহর নিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তিনি চাঁদাবাজিও করেছেন। তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক। এখন পর্যন্ত হাজার কোটি টাকার ওপর সম্পদ জি কে শামীমের পাওয়া গেছে। ওই সম্পদের উৎস সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি তিনি।

জানা গেছে, যুবলীগের অন্তত দু’জন শীর্ষ নেতাকেও মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিতেন শামীম। তাদের নাম ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। এ ছাড়া আরও কয়েকজন বড় সরকারি কর্মকর্তাও শামীমের টাকার ভাগ পেত। তাদের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, শামীম নিজেই কমিশনের অর্থ বণ্টন করতেন। অধিকাংশ সময় কমিশন হিসেবে নগদ টাকা দিতেন। শামীমের দু’জন বিশ্বস্ত সহযোগীর মাধ্যমে কমিশনের টাকা পৌঁছে দেওয়া হতো। শামীম প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা ও কিছু নেতাকে ম্যানেজ করেই ‘ঠিকাদার মোগলে’ পরিণত হন। জি কে শামীমের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকার মাসোহারা ও কমিশন কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা নিয়েছেন। তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।

চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ৩২টি অভিযান চালায় র‌্যাব। পুলিশ চালিয়েছে ১৭টি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একটি। ওই অভিযানে ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছে ২২৪ জন ও ঢাকার বাইরে ৫৩ জন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে যুবলীগ নেতা ছয়জন, কৃষক লীগ নেতা একজন ও আওয়ামী লীগ নেতা দু’জন। বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ২২ জনের। অভিযানের পর এখন পর্যন্ত অস্ত্র মামলায় জি কে শামীম ও খালেদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে র‌্যাব।

এরই মধ্যে খালেদ, শামীম ও সূত্রাপুরের দুই ভাই এনামুল হক ওরফে এনু ভূঁইয়া, রূপন ভূঁইয়া এবং মোহামেডান ক্লাবের সভাপতি লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার ব্যাপারে যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে গোয়েন্দারা নিশ্চিত যে, অবৈধ উপায়ে তারা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ক্যাসিনো ও ঠিকাদারির একটি সিন্ডিকেট তারা তৈরি করেছেন। সেই সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোটি কোটি টাকার মালিক হন। খালেদ, শামীমের সূত্র ধরে অনেক সরকারি কর্মকর্তার নামও আসছে। তাদেরও আইনের মুখোমুখি করা হবে। খালেদ, শামীম ও লোকমানের নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ থাকার তথ্য মিলেছে।

গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাইয়ের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়া আরও কয়েকজনের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন, যুবলীগের বহিস্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, তার স্ত্রী সুমি রহমান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুন্সী, ফজলুল হক, রোকন উদ্দিন, আবদুল মোমেন চৌধুরী ও আবদুল কাদের চৌধুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *