পুলিশ হেফাজতেও দম্ভ সাহেদের
গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালেও প্রতারক মো. সাহেদ করিমের দাম্ভিকতা কমেনি। এত এত কুকর্ম করলেও সে জন্য তার বিন্দুমাত্র অনুতাপও নেই; বরং পুলিশ-র্যাবের শীর্ষ কর্তাদের কাছে বহুরূপী এ প্রতারক দৃঢ়কণ্ঠে বলছেন, ‘জামিন পাওয়ার পর আবার আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে। তখন জীবনের অনেক কাহিনি শোনাব।’ তিনি এও বলেন, ‘একজন সম্পাদক ও প্রকাশককে এভাবে নাজেহাল করা ঠিক হয়নি।’ দাবি করেছেন, তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মন্ত্রী-এমপি হওয়ারও স্বপ্ন ছিল তার। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গতকাল সমকালকে এসব তথ্য জানান।
ওই কর্মকর্তা জানান, কর্মজীবনে তিনি অনেক ধরনের প্রতারক ও অপরাধীকে সামলেছেন। কিন্তু সাহেদের মতো এত ধূর্ত লোক দেখেননি। তার মাথায় ‘ক্রিমিনাল বুদ্ধি’ গিজগিজ করে। সব বিষয় নিয়েই তার মতো করে যুক্তি দেন সাহেদ। গ্রেপ্তারের পর শত শত প্রতারিত লোক র্যাবের কাছে আসছেন। তারা প্রতিকার চান। সাহেদ অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন তারা আইনি সহায়তা চাইছেন।
সাতক্ষীরায় গ্রেপ্তারের পরপরই সাহেদ কী বলেছিলেন- জানতে চাইলে র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, ধরা পড়ার মুহূর্তে ভারী কণ্ঠে সাহেদ বলছিলেন, ‘আমি একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। পত্রিকার মালিক। আমার রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে।’ পরে সাহেদ আরও বলেন, ‘নিয়মিত টক শো করি। আমি সাভারের রানা প্লাজার রানা নই। আমাকে রানা বানানো ঠিক হবে না। আমার কাজের জন্য অনুতপ্তও নই।’
একাধিক নির্ভরশীল সূত্র সমকালকে জানায়, গ্রেপ্তারের আগে একটি ভাড়া গাড়িতে সাতক্ষীরা যান সাহেদ। সেখানে তিনি তার এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। রাতেই ওই আত্মীয়ের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করেন। তবে সাহেদের মামা তাকে সেখানে আশ্রয় দিতে চাননি। বুধবার ভোররাতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সাহেদ স্থানীয় বাচ্চু মাঝির সঙ্গে অবৈধ একটি সিম দিয়ে যোগাযোগ করেন। বাচ্চু মাঝি তাকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
জানা গেছে, সাহেদদের আদিবাড়িও পশ্চিমবঙ্গে। বাচ্চু মাঝি আগে থেকেই তার চেনাজানা ছিল। দীর্ঘদিন অবৈধপথে লোক আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমান্তে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে বাচ্চু মাঝির। লবঙ্গবাতি খাল হয়ে ইছামতী নদী হয়ে ভারতে পালানোর ছক ছিল সাহেদের।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর গা-ঢাকা দেন সাহেদ। ওই রাতেই সাহেদ তার মোবাইল সিম বন্ধ করে দেন। তবে সেই রাতে ঢাকার একটি হোটেলে ছিলেন তিনি। এরপর মাধবদী ও কুমিল্লায় যান। কুমিল্লায় এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেটা ব্যর্থ হলে কুমিল্লায় একটি হোটেলে রাত কাটান। ওই হোটেলের পাশেই একটি সেলুন থেকে চুলে কালো কলপ দেন। আর হোটেলরুমে নিজের গোঁফ কাটান। তৃতীয় দিন কুমিল্লা থেকে নরসিংদীর দিকে রওনা দেন। তবে পথে পুলিশ চেকপোস্টের সামনে পড়ায় গাড়ি ছেড়ে গ্রামের মধ্যে পালিয়ে যান।
দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, পলাতক থাকাকালে সাহেদ মোবাইলে পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একাধিক আইনজীবীর সঙ্গেও তার কথা হয়। গ্রেপ্তার এড়িয়ে আদালতে কীভাবে আত্মসমর্পণ করা যায়, সে পরামর্শ চান তিনি। আত্মসমর্পণ করানোর ব্যবস্থা করিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। গ্রেপ্তার ও সাংবাদিকদের এড়িয়ে সরাসরি কারাগারে যাওয়ার প্ল্যান ছিল তার। তবে শেষ পর্যন্ত কেউ তাকে এ কাজে সহায়তা করতে রাজি হননি।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট আরেকজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, পলাতক থাকাকালে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে এক সহযোগীর আশ্রয় চান। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানকার কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেও অল্পের জন্য ফসকে যান সাহেদ। পলাতক থাকাকালে কখনও নিজের গাড়ি, কখনও রেন্ট-এ-কার, কখনও বাস-লেগুনায় তার যাতায়াত ছিল। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে সাবেক এক রাষ্ট্রদূতের কাছে আশ্রয় চান সাহেদ। তবে ইতিবাচক সাড়া পাননি।
একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তারকালে অবৈধ সিম ব্যবহার করায় তাকে ধরতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। বারবার অবস্থান বদল করছিলেন তিনি। সাতক্ষীরা থাকাকালে একটি অবৈধ ভারতীয় সিমও ব্যবহার করেন সাহেদ।
নিজের অপকর্ম ঢাকতে সাহেদ যুক্তি দেন, কতজনই তো অবৈধ কাজ করে খাচ্ছে। তার কাজ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছিলেন তিনি। তবে চিকিৎসার নামে অনৈতিক বাণিজ্যের সঙ্গে কর্মীদের জড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। যদিও তদন্তে জানা গেছে, সব অপকর্মের পরিকল্পনা সাহেদের মাথা থেকেই এসেছিল।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র বলছে, সাহেদকে গ্রেপ্তারের পর অস্ত্রসহ যে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তা কেউ বিকৃত করে প্রচার-প্রকাশ করেছে। কারা এটা করেছে, তা তদন্ত করা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে সাহেদের কাছে যে অস্ত্র পাওয়া যায়, তার রং বদলে ফেলা হয়েছে। ছবিটিতে সেটিকে প্লাস্টিক অস্ত্রের মতো দেখানোর চেষ্টা করা হয়।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একজন কর্মকর্তাকে সাহেদ বলেন, ‘স্যার, আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে। হয়তো আপনি তখন আরও বড় পদে থাকবেন। তখন অনেক গল্প বলব।’
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, বিএনপির একজন নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা সাহেদ স্বীকার করেছেন। পরে আওয়ামী লীগের অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা জানান। রাজনীতিক নেতা হয়ে ওঠার বড় স্বপ্ন ছিল তার।
জানা গেছে, সাহেদের অবৈধ অর্থের অনুসন্ধান চলছে। বিদেশে টাকা পাচার করেছেন কিনা, তা নিয়েও চলছে অনুসন্ধান। সাহেদের স্ত্রী, বিশ্বস্ত কর্মী ও আরও কয়েকজন সন্দেহভাজনের নামে-বেনামে থাকা ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা হবে।
সাভার থেকে সাহেদের চেকবইসহ দু’জন গ্রেপ্তার :সাভার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সাভারের আশুলিয়া থেকে সাহেদের সিল ও স্বাক্ষরসংবলিত ব্যাংকের চেকবইয়ের ৪৮টি পাতা ও মাদকসহ দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে র্যাব। বৃহস্পতিবার বিকেলে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতেই তাদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করে র্যাব। পরে গতকাল শুক্রবার দুপুরে ওই মামলায় দু’জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠিয়েছে আশুলিয়া থানা পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলো রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের ভায়রা গিয়াস উদ্দীন জালালী ও তার গাড়িচালক মাহমুদুল হাসান। গিয়াস উদ্দীনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানার রূপসাদী গ্রামে। আর মাহমুদুলের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ছোট কৃষ্টনগরে।
পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মাদক বেচাকেনার সময় র্যাব-১-এর একটি দল আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকা থেকে তাদের আটক করে। এ সময় প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের সিল ও স্বাক্ষরিত প্রিমিয়ার ব্যাংক, গরীবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউ শাখার চেকবইয়ের ৪৮টি পাতা, রিদম ট্রেডিংয়ের নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রগতি সরণি শাখার একটি চেকবই, ১০ বোতল ফেনসিডিল ও দুই হাজার ১২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
এদিকে সাহেদের প্রতারণা, নির্যাতন নিয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য একটি হটলাইন চালু করেছে র্যাব। একই সঙ্গে ই-মেইলেও লিখিত আকারে অভিযোগ জানানো যাবে বলে গতকাল র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। প্রতারণা বা নির্যাতনের শিকার যে কেউ হটলাইন নম্বর- ০১৭৭৭৭২০২১১ এবং rabhq.invest@gmail.com এই মেইলে যোগাযোগ করতে পারবেন।