ধর্ষণের দায় স্বীকার, তবে ডিএনএ মিলল না কেন

ভুলিয়ে ভালিয়ে ১৬ বছর বয়সী বাক্প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে ধর্ষণ করার অভিযোগে অভিযুক্ত এলাকারই তিনজন। ধর্ষণের শিকার কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে, জন্ম দেয় এক ছেলের। ঘটনাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার। সংবাদটি ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরপ্রথম আলোয়প্রকাশিত হয়।

পরে মামলা হলে, অভিযুক্তদের দুজন ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পর ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু অভিযুক্ত তিনজনের সঙ্গে শিশুর ডিএনএ মেলেনি। কেন মেলেনি, এ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও।

বাক্‌প্রতিবন্ধী কিশোরীর পরিবারের অভিযোগ, ধর্ষকদের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার তথ্যে গরমিল করা হয়েছে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, প্রভাবশালীর পরিবার টাকা খরচ করে হলেও ডিএনএ পরীক্ষার ফল পরিবর্তন করবে বলে হুমকি দিয়েছিল।

বাক্প্রতিবন্ধী কিশোরী বিজয়নগর উপজেলার এক শ্রমজীবীর মেয়ে। অভিযুক্ত ধর্ষকদের বাড়িও একই এলাকায়। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নির্ধারিত সময়ের মাসখানেক আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ছেলেসন্তানের জন্ম দেয় কিশোরী।

স্থানীয় বাসিন্দা, মামলার এজাহার ও প্রতিবন্ধীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ মে থেকে ১ অক্টোবরের মধ্যে এলাকার নূর আলমের সহযোগিতায় শামীম মিয়া (২৩) বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ওই বাক্প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ডেকে একটি বাগানে একাধিকবার ধর্ষণ করেন। একসময় মেয়েটির শারীরিক পরিবর্তন দেখে বড় বোনের সন্দেহ হয়।

কিশোরীর বাবা ও বোন বলেন, ‘২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জেলা শহরের নাজ মেডিকেল হলে পরীক্ষা করে অন্তঃসত্ত্বার বিষয়ে নিশ্চিত হই। পরে থানায় গিয়ে মামলা করি।’ তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন কুমার আদিত্য মামলাটি লিখে দেন।

ঘটনা কে ঘটিয়েছে—জানতে চাইলে প্রতিবন্ধী কিশোরী ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে পরিবারের কাছে প্রতিবেশী শামীমকে চিনিয়ে দেয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মধু মিয়া বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার সালিসও করেন। সেখানেও শামীমকে ইঙ্গিত করে ওই প্রতিবন্ধী।

২০১৯ সালের ২ অক্টোবর প্রতিবন্ধী কিশোরীর বাবা বাদী হয়ে শামীম ও তাঁর সহযোগী নূর আলমকে আসামি করে বিজয়নগর থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ওই দিনই অভিযুক্ত শামীম মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। পরে শামীমের দেওয়া তথ্য ধরে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে শিপন মিয়া (১৫) নামের এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা আহমেদ ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর শামীমের এবং ৪ অক্টোবর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তারান্নুম রাহাত শিপন মিয়ার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নথিভুক্ত করেন। জবানবন্দিতে শামীম জানিয়েছেন, ভয় দেখিয়ে ও মাঝেমধ্যে খাবার দিয়ে প্রতিবন্ধী মেয়েটির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন তিনি। শামীমের সঙ্গে একই গ্রামের রুবেল ও শিপনের পরিচয় ছিল আগে থেকেই। তাঁদের কথায় দুই দিন ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করেন। বাক্প্রতিবন্ধী কিশোরী প্রায়ই বাড়ির বাইরে থাকত এবং যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াত। সেই সুযোগে ধর্ষণ করেছেন বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন শামীম।

জবানবন্দিতে শিপন জানায়, প্রতিবন্ধী কিশোরী তার চাচাতো বোন। এক রাতে তাকে তার নানার একাশিয়াগাছের বাগানে নিয়ে যায় রুবেল ও শামীম। সেখানেই কিছুক্ষণ পর রুবেল ওই কিশোরীকে বাড়ি থেকে আনে। শিপনের সামনেই রুবেল ও শামীম কিশোরীকে ধর্ষণ করে। শিপনকেও ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ধর্ষণে বাধ্য করে বলে জবানবন্দিতে বলেছে শিপন।

প্রশ্ন অনেক

গত বছরের ১৪ জানুয়ারি প্রতিবন্ধী কিশোরী ও আসামিদের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা ও প্রোফাইলিং সংরক্ষণের জন্য আদালত ঢাকার মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চিফ ডিএনএ অ্যানালিস্ট এবং ডিএনএ ল্যাবকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেননি বলে কিশোরীর পরিবার অভিযোগ করে। পুলিশ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত শিশুর সঙ্গে ধর্ষকদের ডিএনএ পরীক্ষার জন্যও আদালতে কোনো আবেদন করেনি। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত জেনেও পুলিশ দীর্ঘদিন রুবেলকে গ্রেপ্তারের পদক্ষেপ নেয়নি। পরে গত বছরের ১৪ অক্টোবর হবিগঞ্জের মনতলার আবজালপুর থেকে রুবেল মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এখন কারাগারে। তবে শামীমের সহযোগী নূর আলম এখনো গ্রেপ্তার হননি।

গত ২০ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার সাদাত অভিযুক্ত তিন ধর্ষক, বাক্‌প্রতিবন্ধী কিশোরী ও তার শিশুর ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নির্দেশ দেন। ওই দিনই বিজয়নগর থানা-পুলিশ পিতৃপরিচয় নিশ্চিত করতে শিশু, প্রতিবন্ধী ও অভিযুক্ত তিন ধর্ষককে ঢাকায় ডিএনএ পরীক্ষাগারে নিয়ে যান। সাড়ে তিন মাস পর চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি পুলিশের সিআইডি ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠান। আনোয়ার সাদাত প্রতিবেদনটি হাতে পান। প্রতিবন্ধী কিশোরীর রক্ত, তার শিশুর বাক্কাল সোয়াব ও অভিযুক্ত তিন ধর্ষকের রক্ত নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে শামীম, শিপন ও রুবেল প্রতিবন্ধীর জন্ম দেওয়া শিশুর জৈবিক পিতা নয়।বিজ্ঞাপন

ইউপি সদস্য মধু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার সালিসে বসেছিলাম। প্রতিবন্ধী কিশোরী আকার-ইঙ্গিতে শামীমের কথা বলেছে। কিন্তু শামীমের পরিবার মানতে রাজি হয়নি।’

প্রতিবন্ধীর মা–বাবা ও বড় বোন জানান, ডিএনএ পরীক্ষার সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা বিজয়নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফয়সাল আহমেদ ২০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। টাকা না থাকায় তাঁরা দিতে পারেননি। এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন ফয়সাল আহমেদ।

এই মামলাটি এর আগে তিন পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত করেছেন। তাঁরা হলেন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন কুমার আদিত্য, আমিনুল ইসলাম ও প্রভাত চন্দ্র দাস। বর্তমানে ফয়সাল আহমেদ মামলাটি তদন্ত করছেন।

বাড়িতে গিয়ে শামীমকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর মা বলেন, ‘আমার ছেলেকে ডিএনএ পরীক্ষার লাইগ্যা নিয়া গেছে। কিন্তু রিপোর্টে কিছু আসে নাই। আমার ছেলে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। পুলিশ মারধর কইরা সব স্বীকার করাইছে।’

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘ধর্ষণ একটি অপরাধ। যাঁরা ধর্ষণ করেছেন, তাঁরা ওই প্রতিবন্ধীর শিশুর বাবা না–ও হতে পারেন। কার দ্বারা প্রতিবন্ধী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, সেটি বলা মুশকিল। কে বাবা, সেটি মা-ই বলতে পারবে। এখন ডিএনএ বিশ্লেষণের বাইরে আমাদের বলার কিছু নেই।’

গত রোববার দুপুরে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মো. রইছ উদ্দিন মামলার নথিপত্র দেখিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ এই মামলাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। দ্রুত ডিএনএ টেস্ট করিয়েছে। এখন ডিএনএ বিশ্লেষণের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। ডিএনএ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রেও প্রভাবিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আদালতের বিজ্ঞ বিচারকদের সঙ্গে কথা বলেছি।’

অভিযোগ স্বীকার–অস্বীকার, ডিএনএ নমুনায় মিল না পাওয়ার রহস্য ইত্যাদি নিয়ে তদন্ত চলতে থাকবে, বিচারপ্রক্রিয়াও এগোবে আইনি পথে। কিন্তু বাক্‌প্রতিবন্ধী একটি মেয়েকে কিশোর বয়সে মা হতে হলো, তার শারীরিক–মানসিক স্বাস্থ্যের কী দুরাবস্থা হলো সে খবর কে রাখে! পাশাপাশি এই ছোট্ট শিশুর পিতাই–বা কে? কে দায়িত্ব নেবে অবলা কিশোরী আর তার সদ্যোজাত সন্তানের? প্রতিবন্ধী মেয়েটি কিন্তু এসব প্রশ্ন করতেই পারে সমাজের কাছে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়াই এখন জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *