একটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম ৩৫৬ টাকা
করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কত টাকার মাস্ক কিনেছে, তা জানতে চেয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।
কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্প
- সার্জিক্যাল মাস্ক ১ লাখ ৭ হাজার ৪০০টি। গড়ে প্রতিটির দাম ৩৫৬ টাকা ৯৬ পয়সা।
- এন-৯৫ মাস্ক ৫ লাখ ২৯ হাজার ৬২০টি। গড়ে প্রতিটির দাম ২৯৩ টাকা ৭৭ পয়সা।
- কেএন-৯৫ মাস্ক ৪ লাখ ৬০ হাজার। গড়ে প্রতিটির দাম ৪২৮ টাকা।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া একটি প্রকল্পের আওতায় অস্বাভাবিক দামে সার্জিক্যাল মাস্ক কিনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি এন-৯৫ মাস্কের চেয়েও বেশি দামে কেনা হয়েছে এসব মাস্ক।
গত রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে দেওয়া হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওই প্রকল্পের আওতায় গড়ে প্রতিটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম পড়েছে ৩৫৬ টাকা ৯৬ পয়সা। একই প্রকল্পে প্রতিটি এন-৯৫ মাস্কের দাম পড়েছে ২৯৩ টাকা।
এসব মাস্ক কেনা হয়েছে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পের আওতায়। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে এপ্রিলে সরকার জরুরি ভিত্তিতে এই প্রকল্পটি নিয়েছিল
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কত টাকার মাস্ক কিনেছে, তা জানতে চেয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। হিসাবে দেখা যায়, করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ৭ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) মাধ্যমে ২৬৬ কোটি ১৭ লাখ ২৪ হাজার টাকায় তিন ধরনের মাস্ক (সার্জিক্যাল, এন-৯৫, কেএন-৯৫) কিনেছে। অন্যদিকে ওই প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই তিন ধরনের মাস্ক কিনতে খরচ হয়েছে ৩৯ কোটি ৯ লাখ ২২ হাজার ৩৩৩ টাকা।
ওই প্রকল্পের হিসাবে দেখা যায়, সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা হয় মোট ১ লাখ ৭ হাজার ৪০০টি। এতে খরচ হয় ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯৩ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি মাস্কের দাম পড়েছে ৩৫৬ টাকা ৯৬ পয়সা। একই সময়ে সিএমএসডির মাধ্যমে কেনা হয়েছে ১ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক। খরচ হয়েছে ২৩ কোটি ২৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। সিএমএসডির প্রতিটি মাস্কের দাম পড়েছে ২১ টাকা ৭২ পয়সা।
এ ছাড়া ওই প্রকল্পের আওতায় এন-৯৫ মাস্ক কেনা হয় ৫ লাখ ২৯ হাজার ৬২০টি। গড়ে প্রতিটির দাম পড়েছে ২৯৩ টাকা ৭৭ পয়সা। আর কেএন-৯৫ মাস্ক কেনা হয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার। গড়ে প্রতিটির দাম পড়েছে ৪২৮ টাকা।
সার্জিক্যাল মাস্কের অস্বাভাবিক দামের বিষয়ে জানতে চাইলে কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের পরিচালক আজিজুর রহমান সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গত নভেম্বরে এই প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছেন। এগুলো মূলত তার আগে কেনা হয়েছে। যার ফলে তখনকার প্রেক্ষাপট কী ছিল, তা তিনি বিস্তারিত বলতে পারছেন না। তিনি মাস্কের যে হিসাব পেয়েছেন, সেটাই সংসদীয় কমিটিতে দিয়েছেন। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ যদি বলে তাহলে তাঁরা এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখবেন।
আজিজুর রহমান সিদ্দিকীর আগে এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন ইকবাল কবির। প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাঁকে এই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘এ বিষয়ে বর্তমান পিডির (প্রকল্প পরিচালক) সঙ্গে কথা বলেন।’
সিএমএসডি সূত্র জানায়, কেএন-৯৫ মাস্কের দাম এন-৯৫ মাস্কের দামের চেয়ে কম। প্রকল্পের কেনা কিছু এন-৯৫ মাস্ক সিএমএসডিকে সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো আসলে ছিল কেএন-৯৫ মাস্ক। এগুলোর মান নিয়ে আপত্তি তুলেছিল সিএমএসডি। কিছুদিন আগে তারা সার্জিক্যাল মাস্ক কিনেছে ৮ টাকা করে আর এখন কিনছে ৩ টাকা দরে।
ঢাকার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখন মানভেদে খুচরায় ২ থেকে ১০ টাকায় একটি সার্জিক্যাল মাস্ক পাওয়া যায়। দোকানিরা বলেছেন, গত বছর করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মাস্কের সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন দাম বেড়েছিল। অনেকের কাছে তখন এই মাস্ক ছিল না। কিন্তু একটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম ৩৫০ টাকার বেশি হবে, এমন ছিল না। তখন ২৫-৩০ টাকায় মাস্ক বিক্রি হয়েছে।
করোনাকালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী যেমন পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি দিয়ে আসছে সরকার। সিএমএসডি মূলত এসব সামগ্রী সংগ্রহ ও বিতরণ করে। পাশাপাশি ওই প্রকল্পের মাধ্যমেও এসব সামগ্রী ক্রয় ও বিতরণ করা হচ্ছে। গত বছরের জুনে এই প্রকল্পের মাধ্যমে কেনা পিপিইর মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
গত বছর করোনা সংক্রমণের শুরুতে এসব সামগ্রী বিতরণের সময় এন-৯৫ মাস্কের নামে দেশে তৈরি নিম্নমানের মাস্ক দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঘটনা তদন্ত করে সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি। ওই ঘটনায় মামলা চলমান।
করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির নানা অভিযোগ ওঠে। গত নভেম্বরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছিল, জরুরি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সরকারি ক্রয় বিধিমালা ২০০৮ লঙ্ঘন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনেক ক্ষেত্রে মৌখিক আদেশে ক্রয় করা হয়েছে এবং কোনো ক্রয়ে ই-জিপি মাধ্যম ব্যবহার করা হয়নি।
মাস্কের অস্বাভাবিক বেশি দামের বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যদিও এটা জরুরি প্রকল্পের আওতায় কেনাকাটা, তারপরও প্রচলিত বাজার দরের কয়েক গুণ বেশি দামে কেনা যৌক্তিক নয়। এই কেনাকাটা বেসরকারি সরবরাহকারীর মাধ্যমে করা হয়ে থাকলে বুঝতে হবে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে দুর্নীতি হয়েছে। এটি তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। না হলে অনিয়ম-দুর্নীতি বাড়তে থাকবে।