সরকারের ‘আমলানির্ভরতায়’ ক্ষোভ, সতর্ক হতে বলছেন রাজনীতিকেরা
–
আওয়ামী লীগ অনেকাংশে আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে। জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। আজ সোমবার জাতীয় সংসদে সরকারের এই আমলানির্ভরতার সমালোচনা করেছেন সাংসদেরা।
আওয়ামী লীগও কি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে—এই প্রশ্ন দলের ভেতরেই আলোচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নেওয়া ‘মুজিব বর্ষের’ অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালায় আমলাদের প্রাধান্য নিয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে দুঃখ প্রকাশও করেছেন। করোনা সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিও দলীয় নেতারা আমলানির্ভরতা হিসেবেই দেখছেন। এমনকি বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেওয়া নিয়েও আলোচনা আছে।
আজ সংসদে অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর সহচর ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সাংসদেরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে।
সাংসদ তোফায়েল বলেন, ‘আমরা যারা এই জাতীয় সংসদের সদস্য, এমন একজনও নেই যিনি এই করোনাকালে নিজস্ব অর্থায়নে বা যেভাবেই হোক গরিব–দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সবাই দাঁড়িয়েছেন। আমি আমার নিজের এলাকায় ৪০ হাজার মানুষকে রিলিফ দিয়েছি। এখন আমাদের মাফ করবেন, কথা বলাটা কতটা যুক্তিসংগত জানি না। এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দিই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন। অথচ প্রশাসনিক যাঁরা কর্মকর্তা, তাঁরা কিন্তু যানইনি। যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনি এখন পর্যন্ত যাননি। এটা কিন্তু ঠিক নয়। একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ফেরাউনের সময়ও আমলা ছিল। এসব কথাবার্তা মানুষ পছন্দ করে না। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘যাঁরা রাজনীতিবিদ, যাঁরা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাঁদের জন্য নির্ধারিত স্থান যে আছে, সেখানে তাঁদের থাকা উচিত। কারণ, আমাদের জেলায় একজন সচিব যাবেন। আমরা তাঁকে বরণ করে নেব, ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা যান না। এক দিনের জন্য তাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত।’
আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতা বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে গেলে কর্মীরা আসতেন। মন্ত্রীরা গ্রামগঞ্জে যেতেন। কোথায় যেন সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমালোচিত হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা অকার্যকর করার অভিযোগে। মানুষের ‘ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার’ জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ। পরে ওই বছরের জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি দলটি। ২০০৯ সালে পরিবর্তনের ডাক এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে আবার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
২০১৪ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ একতরফা জয় পায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও সবার জন্য সমান মাঠ নিশ্চিত না হওয়া এবং প্রশাসনের সহায়তায় বিজয় নিশ্চিত করার অভিযোগ ওঠে। মূলত ২০১৪ সালের একতরফা জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও বিরোধীদের মাঠছাড়া করা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া, ভোটের দিন জবরদস্তি, জাল ভোট প্রদান—এসব অনেকটা রীতি হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক মহলে এমন আলোচনা আছে যে ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে সরকারি চাকুরেদের ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, নাগরিক সংগঠনের অনেকের অভিযোগ, প্রশাসনের সহায়তায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। এ কারণে প্রশাসন ও পুলিশের প্রভাব এই সরকারের ওপর বেশি।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, সাংসদদের তোয়াক্কাই করে না প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সাংসদেরা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই সরকারের আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করে আসেছেন দলটির নেতারা। এর পরিণাম সম্পর্কে বিভিন্ন সভা–সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলনে সরকারকে সতর্ক করেছেন নেতারা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় না আসায় সরকার ভয়ে থাকে। যেহেতু মানুষের মধ্যে সরকারের কোনো ভিত নেই, তাই প্রশাসন ও পুলিশ এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে জনগণকে দাবিয়ে রেখে ক্ষমতা ধরে রাখছে। তিনি বলেন, একসময় প্রশাসন–পুলিশ কেবল বিরোধী দল দমনে ব্যস্ত ছিল।
এখন সরকারি দলের ওপর ভর করেছে। মন্ত্রী–সাংসদেরা এদের কাছে এখন কিছুই নন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারি দলের নেতারাই এখন আমলানির্ভরতা নিয়ে কথা বলছেন। সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে যে ‘পদ্ধতি’তে এগোচ্ছে, তা বুমেরাং হচ্ছে। এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা।
আজ সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ ফিরোজ রশীদ বলেছেন, আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে, কারণ দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির নামে এখন পালাগানের অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যার সময় ওবায়দুল কাদের একদিকে পালাগান করেন, একটু পর টিভিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরেকটা পালাগান করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘এখন রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা ঘরে বসে টেলিভিশনে পালাগানের রাজনীতি দেখি। এই পালাগান চলছে ১০ বছর। রাজনীতিশূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই।’
জাতীয় পার্টির এই সাংসদ বলেন, ‘প্রতিটি জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশাপাশি বসে থাকেন, দূরে। এরপর বলে ডিসি সাব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না।’
কাজী ফিরোজ বলেন, ‘রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছেন। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদেরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথচ এই দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদেরা।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম মনে করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনেরা আমলানির্ভর হয়ে পড়েন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমলারা পুরোপুরি এই সরকারকে ঘিরে ফেলে। এখন সরকারদলীয়রা এটা বলছেন, কেননা এর নেতিবাচক প্রভাব তাঁদের ওপরও পড়ছে। দেরিতে হলেও সরকারদলীয়দের উপলব্ধি ভালো হয়েছেন। তবে তিনি মনে করেন, সরকারকে সতর্ক করে বার্তা দেওয়া হলেও এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসাটা কঠিন। রাজনীতিবিদেরা একেবারেই প্রান্তিক হয়ে গেছেন।