নাম তার জিয়াউর রহমান
লিখেছেন রেদোয়ানুর রহমান
জিয়াউর রহমানের বয়স যখন ঠিক আমার এই বয়স – আমার যে বয়সী বন্ধুরা আমাকে ফেসবুকে ক্রিমিনাল মাইন্ড খেলার আমন্ত্রণ জানায়, কোন গাড়ী কতোটা তেজী এ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে – সে বয়সে তিনি একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, যুদ্ধও করেছিলেন – দর্শক হন নি। আমার যে বন্ধুরা আমার চেয়ে একটু বড় – তারা যে বয়সে ফ্রেন্ডলিস্টে কে থাকবে আর কে থাকবে না এই চিন্তায় মশগুল – সে বয়সে তিনি মন্ত্রীসভায় কে থাকবে আর না থাকবে এই চিন্তা করছিলেন।
হ্যা তিনি মাত্র ৩৯ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এবং খুব যে খারাপ করেছিলেন তা মনে হয় না। ইন ফ্যাক্ট আজকে আমরা জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশেই বাস করছি, শেখ মুজিবের বাংলাদেশে না। তিনি মাত্র ৫ বছর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। এতো অল্প সময়ে আজকের বিচারে বাচ্চা একটা ছেলে (আন্দালিব পার্থ-সজীব ওয়াজেদ জয়ের বয়স, মাহী বি চৌধুরীর এখন যে বয়স তার চেয়ে মাত্র এক বছর বেশী বেঁচে ছিলেন জিয়াউর রহমান), তাও আবার মিলিটারী ব্যাকগ্রাউন্ড এর (তার বয়সী ছেলেপেলেরা এখন এ বয়সে মেজর থাকে) একটা দেশের এতো দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন কীভাবে করেছিলেন এটা ভেবে দেখবার বিষয়।অনেকেই বলেন তিনি একনায়ক ছিলেন বলে তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভবপর ছিলো। এ কথার সত্যতা আছে কিন্তু কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার দিক থেকে শেখ মুজিবর রহমান, খালেদা জিয়া কিংবা হাসিনা তার চেয়ে কোনো অংশে কম নন কিংবা ছিলেন না। ইন ফ্যাক্ট হাসিনা এখন যে সর্বময় ক্ষমতা উপভোগ করছেন, তার পিতাও সে ক্ষমতা উপভোগ করেছিলেন কি না সন্দেহ?
সর্বময় ক্ষমতা কেন তারা দেশকে য়ুনিফাই করার কাজে লাগান না, লাগান নাই এই প্রশ্নটা করা খুব জরুরী। তিনি বাংলদেশের একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান যিনি মেরিটোক্রেসিতে বিশ্বাস করেছিলেন এবং সব দল ও মত থেকে চেরি পিক করে সফল ও প্রতিভাবান মানুষদের রাজনীতিতে এনেছিলেন। জিয়া-ব্যাশাররা এই কাজটিকে বিশেষ অপছন্দের চোখে দেখেন কিন্তু ম্যান্ডেলার But this is no time to celebrate petty revenge. This is the time to build our nation using every single brick available to us – even if that brick comes wrapped in green and gold – এই উক্তিতে আবার বেএন্তেহা উদ্বেলিত হন। জিয়াউর রহমানের তৈরী প্রেস কাউন্সিলটা একবার দেখবেন। এ বি এম মুসা আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করা মানুষ – তিনি যোগ্যতাবলেই ওখানে স্থান পেয়েছিলেন। আজকে হাসিনা-খালেদা এই কাজটি করতে পারবেন কি না আপনারাই জানেন। যারা এপার্থাইড সরকারে থেকে সরাসরি বর্ণবাদের পক্ষ নিয়েছিলেন, শাদা হয়ে যারা কালোদের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অত্যাচার করেছিলেন, ম্যান্ডেলা তাদের এলিমিনেট করেন নি, কাজে লাগিয়েছিলেন। এটাই স্টেটসম্যানশিপ।
খুবই বিপজ্জনক পথ কিন্তু এটাই সঠিকপথ। জাতিকে ভাগ করা খুবই সহজ কাজ, এ কাজে ভুল হয় না কিন্তু একত্র করা খুবই কঠিন কাজ, এই কাজে ভুল হয় সবচেয়ে বেশী – কেননা য়ুনিফাই করার কোনো হ্যান্ডবুক থেকে না, আপনাকে ক্রিয়েটিভ হতে হয়, আপোষ করতে হয়। জিয়াউর রহমানেরও ভুল হয়েছিলো, প্রচুর ভুল হয়েছিলো কিন্তু তিনি পকেট ভারী করার জন্য ভুল করেন নি। হ্যা তিনি বিতর্কিত মানুষদের ক্ষমতায় এনেছিলেন, প্রতিভান মানুষ মাত্রই বিতর্কিত – কিন্তু এরা বিতর্কিত ছিলেন তাদের বিশ্বাস আর চেতনার কারণে: চুরি-বাটপারির জন্য না। আপনি নেশান বিল্ডিং করবেন কিন্তু কনসেশন করবেন না – এই ধরনের আজগুবি চিন্তা গর্দভ ছাড়া কেউ করে না। মাল-মুহিত হয়তো মানুষ ভালো, দুর্নীতিও করেন না এবং নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির লোক। কিন্তু তাকে দিয়ে আপনি কাজের কাজ করবেনটা কী?
বরঞ্চ অযোগ্য লোকদের ক্ষমতায় আনলে ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি কেননা তাদের সব সমস্যা সমাধানের সময় থাকে শুধু নিজের দায়িত্বে যা আছে তা ছাড়া। এখন থেকে ৩৫ বছর আগে সদ্য স্বাধীন দেশে যখন হাতে গুনেও যোগ্য মানুষ পাওয়া যেতো না, তখন কি আপনি দক্ষতা দেখতেন না পাকিস্তান না ভারত-পন্থী এই কাজিয়ায় যেতেন। আজকে এই বহুধা বিভক্ত জাতিতে শুধু এই কাজটিই যদি কেউ করতে পারে, আমি তাকে পূর্ণ সমর্থন দেবো, মখা, আবুল, শেখ কেউই যদি পারে তাকেই আমি সমর্থন দেবো। কথার কথা বলছি না, ভেবেচিন্তেই বলছি।
৭০ পূর্ব প্রি থেচার-রিগ্যান আমলে তৃতীয় বিশ্বের মিলিটারী ডিক্টেটর হয়েও তিনি যে সোশ্যালিজমের ঝাণ্ডা উড়াতে যান নাই এটাই তার সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি। আদর্শের দিক থেকে সোশ্যালিজমের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে কিন্তু আমরা সোশালিস্ট একেনমির রাস্তায় ঢুকলে সাড়ে সর্বনাশ হতো – উদাহরণ আমাদের পাশেই আছে। কোলকাতা একশ বছর আগে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শহর ছিলো (সিডনি, মেলবোর্ন, ম্যানচেষ্টার এরও আগে ) । জিয়াউর রহমান রিয়ালিস্ট ছিলেন, তাকে পছন্দ করার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। আইডিয়ালিস্টরা যেই রিসোর্স নাই, সেই রিসোর্স দিয়ে বর্তমান সমস্যার সমাধান করতে চায়, রিয়ালিস্টরা করে যেই রিসোর্স আছে সেই রিসোর্স দিয়ে। মিলিটারী ডিক্টেটররা মৃত্যুর পর ইরেলেভেন্ট হয়ে যান।
জিয়াউর রহমান কীভাবে এটা এড়ালেন সেটা ভেবে দেখবার বিষয়। সম্ভবত মানুষ তার ব্যক্তিগত ইমেজ ছাড়াও কিছু পলিসিকে রেকগনাইজ করেছিলো। তার মৃত্যুর পর বিএনপি যে জাতিকে য়ুনিফাই করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না কিন্তু তাও মানুষ দলটাকে সাপোর্ট করে সম্ভবত এজন্যে যে সাধারণ মানুষ পলিটিশিয়ানদের বাগাড়ম্বর পছন্দ করে না, তত্ত্বকথাও শুনতে চায় না – তারা চায় তাদের সমস্যার সমাধান হোক – যেভাবেই হোক। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই ‘no-nonsense’, ‘whatever works’ এপ্রোচটা বেয়াল্লিশ বছরে এদেশে একজনই নিতে পেরেছিলেন। জিয়াউর রহমানের মারা যাওয়ার দিনে আহাজারি করে, তিনি বেঁচে থাকলে আমরা কৈ চলে যেতাম এসব চিন্তা করে কোনো লাভ নাই। যারা এদেশকে নেতৃত্ব দেবেন বলে আশা করছেন তারা যদি জিয়াউর রহমানের ‘no-nonsense’, ‘whatever works’ এপ্রোচটা নিতে পারেন তাহলে নিজের ও দেশের জন্য কিছু লাভ হবে বলে মনে হয়।